মৃত মা-বাবার জন্য কোন আমল (ইসালে সাওয়াব) করা যাবে কি?

মৃত মা-বাবার জন্য কোন আমল (ইসালে সাওয়াব) করা যাবে কি?

জী অবশ্যই করা যাবে । দলিল সহ বিস্তারিত নিম্নে আলোচলা করা হল—

১. বেশী বেশী দু‘আ করা

আল-কুরআনে এসেছে,

رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا (রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়্যানিস-সাগিরা)

‘‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’’ (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৪)

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতো হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না। ক. সদকায়ে জারিয়া। খ. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃতো হওয়া যায় । . এমন নেক সন্তান- যে দু‘আ করে (সহিহ মুসলিম: ৪৩১০)

২. দান-সাদকাহ করা

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছেন। তাই কোনো অসিয়ত করতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-সাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করলে তিনি কি এর সাওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’’ (সহীহ মুসলিম: ২৩৭৩)

খাবার,পানি,বস্ত্র,অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী আপনি দান করতে পারেন । অনেকে খাবার খাওয়ানোকে বেদাত শিরিক বলে থাকেন যা মুর্খামির পরিচয় । ইসালে সাওয়াব অর্থাত নেকি পৌছানোর উদ্দেশ্যে যাই দান করবেন তার নেকি সে পাবে । ইন শা আল্লাহ ।

৩. মা-বাবার পক্ষ থেকে রোজা পালন করা

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করলো এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিলো। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে’’ (সহীহ বুখারী: ১৯৫২)

কোনো মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিলো, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করলো। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট আসলে তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে রোজা পালন করো। (সহীহ ইবন হিববান: ২৮০)

৪. হজ্জ বা উমরাহ করা

জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে আগমণ করে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি?

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ করো। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মায়ের উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় করো। কেনোনা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’’ (সহীহ বুখারী: ১৮৫২)

৫. মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করা

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানীর জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আয়েশা (রাঃ)কে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আসো, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো করো। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি যবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে কবুল করো”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানী করলেন। (সহীহ মুসলিম: ৫২০৩) এই হাদিস দ্বারা বুঝা গেল কারো পক্ষ থেকে কুরবাণী করলে তার নেকি সে পায় (যার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয় ) অতএব মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করলেও তার নেকি মা-বাবা পেয়ে থাকেন ।

৬. মা-বাবার অসিয়ত পূর্ণ করা

রাশীদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য অসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাকে ডাকো, সে আসলো, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বললো, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বললো, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেনোনা সে মু’মিনা। (সহীহ ইবন হিববান :১৮৯)

৭. মা-বাবার আত্মিয় ও বন্ধুদের সম্মান করা

আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার (রাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ (রাঃ) এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন, যে গাধায় আব্দুল্লাহ (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পড়া ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবান দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বড়ো সওয়াবের কাজ’’ (সহীহ মুসলিম: ৬৬৭৭)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেনো পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ (সহীহ ইবন হিববান: ৪৩২)

৮.মা-বাবার ভালো কাজসমূহ জারী রাখা

মা-বাবা যেসব ভালো কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ, কাউকে মাসিক বা বছরে নির্দিষ্ট দান করে যেতেন, এই ধরনের কাজগুলো সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেনোনা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে।

যে ব্যক্তির ইসলামের ভালো কাজ শুরু করলো, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না’’ (সহীহ মুসলিম:২৩৯৮)

৯.কবর যিয়ারত করা

সন্তান তার মা-বাবার কবর যিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে।

১০..মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিতো করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিতো ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেওয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সুনান আত তিরমিজি :২৪২৮)

সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

Spread the love

Leave a Comment