টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতির আদায় করা যাবে কি? |Islamic post bangla

টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতির আদায় করা যাবে কি?

প্রশ্ন

টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতির আদায় করা যাবে কি? দয়া করে দলীলসহ জানালে কৃতজ্ঞ হবো।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

 বর্তমানে আমাদের দেশে গায়রে মুকাল্লেদগণ ফাতওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ‘‘সহীহ বুখারীর মাঝে আছে ফিতরা দিতে হবে গম, খেজুর, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। টাকা দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে না!!’’

তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
❏ তাছাড়াও ইমাম বুখারী (রহ.), ইবনে আবী শায়বা (রহ.) ও বায়হাকি (রহ.) বলেন, টাকা দিয়ে ফিতরা দিলে আদায় হয়ে যাবে। নিম্মে দেখুন বিস্তারিত….

 (০১) যদি গম, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করে, তাহলে হয়ে যাবে। তার দলীল বুখারী থেকে-

صحيح البخاري (2/ 130)
1503 – حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّكَنِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَهْضَمٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ عُمَرَ بْنِ نَافِعٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى العَبْدِ وَالحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ»
____
[تعليق مصطفى البغا] (فرض) أوجب أو قدر.

 

 

❐ অর্থ : হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর রাসূলুল্লাহ (সা.) زَكَاةَ الفِطْرِ সাদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬।

صحيح البخاري (2/ 131)
1506 – حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ عِيَاضِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي سَرْحٍ العَامِرِيِّ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا سَعِيدٍ الخُدْرِيَّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، يَقُولُ: «كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ»

অর্থ : হযরত আবূ সাঈদ খুদরী(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে زَكَاةَ الفِطْرِ সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬।

উল্লেখ্য যে, উক্ত দুটি হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি চাইলে মাল দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবে। কিন্তু টাকা দ্বারা আদায় করা ভুল এধরনের কোন আলোচনা নেই।

 ‘‘ফিতরা’’ টাকা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। তার দলীল-

مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ
10371 – حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُولُ: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ»

অর্থ : হযরত যুহাইর (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭১। এটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণযোগ্য।

তেমনি ভাবে ইবনে আবী শায়বার মাঝে টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার ব্যাপারে রয়েছে হযরত হাসান বসরী (রহ.) এর আসার-

مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
10370 – حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: «لَا بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ»

অর্থ : হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই। ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭০।

সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে এটি ইমাম বুখারী (রহ.) এরও উক্তি-

فتح الباري لابن حجر (3/ 312)
(قَوْلُهُ بَابُ الْعَرْضِ فِي الزَّكَاةِ)
أَيْ جَوَازُ أَخْذِ الْعَرْضِ وَهُوَ بِفَتْحِ الْمُهْمَلَةِ وَسُكُونِ الرَّاءِ بَعْدَهَا مُعْجَمَةٌ وَالْمُرَادُ بِهِ مَا عَدَا النَّقْدَيْنِ قَالَ بن رَشِيدٍ وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ مَعَ كَثْرَةِ مُخَالَفَتِهِ لَهُمْ لَكِنْ قَادَهُ إِلَى ذَلِكَ الدَّلِيلُ ……الخ

…..আল্লামা ইবনু রাশীদ (রহ.) বলেন, উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারী (রহ.) হানাফীদের সহমত পোষন করেছেন….। ফাতহুল বারী লি ইবনে হাজার-৩/৩১২।

✏ এ বিষয়ে আহমদ আল গুমারী (রহ.) এর আরবী ভাষায় ১৫০ পৃষ্ঠায় ‘‘تحقيق الامال فى فى اخراج زكوة الفطر بالمال’’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা রচনা করেছেন। যা সকলকে পড়ে রাখা আবশ্যক। (আমার কাছে পুস্তিকাটি রয়েছে কারো প্রয়োজন হলে বলবেন)।
এ বিষয়ে আরো দেখুন- বাদায়েউস সানায়ে-২/৯৬৯, আল মাবসুত লিসসারাখসী-৩/১১৩ ইত্যাদি।

 

حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: «لَا بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ»

হযরত হাসান বসরী রহঃ থেকে বর্ণিত। টাকার মাধ্যমে সদকায়ে ফিতির আদায় করাতে কোন সমস্যা নেই। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৬/৫০৮, বর্ণনা নং-১০৪৭১, ১০৩৭০]

 

حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُولُ: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ»

তাবেয়ী ইমাম আবু ইসহাক রহঃ বলেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম রাঃ কে পেয়েছি যে, তারা রমজানের সদকায়ে ফিতির খাদ্যের মূল্য দ্বারা পরিশোধ করতেন। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৬/৫০৮, বর্ণনা নং-১০৪৭২, ১০৩৭১]

 

ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহঃ বলেন,

لا يشترط إخراج التمر أو الشعير أو البر في زكاة الفطر بل لو أخرج قيمتها مما هو أنفع للفقير جاز لأن المقصد منها إغناء الفقراء عن المسألة وسد حاجتهم في هذا اليوم

খেজুর, গম বা যব দিয়ে সদকায়ে ফিতির আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং যদি এর মূল্য দ্বারা আদায় করা হয়, যা গরীবদের জন্য অধিক উপকারী, তবে তা জায়েজ আছে। কেননা, সদকার দ্বারা মূল মাকসাদ হল, গরীবদের দারিদ্রতা দূর করা এবং তার সেদিনের প্রয়োজন পূর্ণ করা। [মাউসূআতু ফিক্বহি সুফিয়ান সাওরী-৪৭৩]

 

টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতির আদায়ের মত ব্যক্ত করেছেন, ইমাম আবূ হানীফা রহঃ, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহঃ, উমর বিন আব্দুল আজীজ রহঃ, হযরত হাসান বসরী রহঃ, ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ, ইমাম তাহাবী রহঃ, ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াই রহঃ, ইমাম আবু সাউর রহঃ। [যাকাতুল ফিতরি আহকামূহা ওয়া নাওয়াজিলুহা, মুহাম্মদ বিন আব্দুল গাফফার শরীফকৃত-১২৫]

 

قَالَ بن رَشِيدٍ وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ

ইবনে রশীদ বলেন, ইমাম বুখারী রহঃ এ মাসআলায় [টাকা দিয়ে সদকায়ে ফিতির আদায় করা] হানাফীদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন। [ফাতহুল বারী-৩/৪৯৭]

উত্তর লিখনে

মুফতী সানাউল্লাহ

আরো কিছু দলীল

হাদীসে বর্ণিত খাদ্য ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা সদকায়ে ফিতির আদায় করা যাবে না মর্মে কোন বর্ণনা নেই।

عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ، قَالَتْ: «كُنَّا نُؤَدِّي زَكَاةَ الْفِطْرِ عَلَى [ص:12] عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُدَّيْنِ مِنَ الْقَمْحِ،

হযরত আসমা বিন আবু বকর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় দুই মুদ গমের ছাতু দ্বারা সদকায়ে ফিতির আদায় করতাম। [আল মু’জামুল আওসাত লিততাবারানী,হাদীস নং-৮৯৭২]

অথচ ছাতু দ্বারা সদকায়ে ফিতির আদায়ের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়নি। সাহাবায়ে কেরামগণের ছাতু দ্বারা ফিতরা আদায় করা প্রমাণ করে, হাদীসে বর্ণিত খাদ্যই নির্দিষ্ট নয়, বরং সমমূল্যের অন্য কিছু দ্বারাও ফিতরা আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত।

হজরত মুয়াবিয়া রাঃ হজ্ব বা উমরার সময় খুতবায় সদকায়ে ফিতির সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ

قَدِمَ عَلَيْنَا مُعَاوِيَةُ الْمَدِينَةَ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا، فَقَالَ: «إِنِّي أَرَى مُدَّيْنِ مِنْ سَمْرَاءِ الشَّامِ يَعْدِلُ صَاعًا مِنَ التَّمْرِ

এক সা’ খেজুর ও শামের ভূসি মিশ্রিত দুই মুদ আটা সমান। [সুনানে দারেমী-১/৪৩৬-৪৩৭, হাদীস নং-১৬৬৩]

হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এক সা’ খেজুরের বদলে শামের ভূসি মিশ্রিত দুই মুদ আটার সমমান সাব্যস্ত করেছেন। যা দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায়,হাদীসে বর্ণিত বস্তুর সমমূল্যমানের বস্তু দ্বারাও ফিতরা আদায় করা যাবে।

সদকা দ্বারা মূল মাকসাদ হল, গরীবদের উপকার করা। আর টাকা পয়সা প্রদান করলে গরীব তার ইচ্ছেমত প্রয়োজন অনুপাতে তা ব্যবহার করতে পারে। শুধু খাদ্য দিয়ে আদায় করলে যা সম্ভব নয়।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আশা করি বিষয়টি দীবালোকের ন্যয় পরিস্কার যে, টাকার মাধ্যমে সদকায়ে ফিতির আদায় করা সম্পূর্ণ শরীয়ত সম্মত। এতে সন্দেহ করার কোন সুযোগ নেই।

Spread the love

Leave a Comment