ভিডিও ও ছবি বানানো বৈধ নাকি অবৈধ?

ভিডিও ও ছবি বানানো বৈধ নাকি অবৈধ?

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমূহ আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো, প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন অনেক কিছু শিখতে পারবেন । ইনশাআল্লাহ

আলোচনার বিষয়

  • অতীত (আগের যুগের) ছবি আর বর্তমান যুগের ডিজিটাল ছবির মধ্যে পার্থক্য কি?
  • ডিজিটাল ইসলামী ভিডিও বানানো কি হারাম?
  • ইসলামী ভিডিও বানানো কতটা জরুরী?
  • গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন

ডিজিটাল ছবি ও ভিডিও নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক দেখা যায় । কেউ ভ্রান্ত আকিদা, নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষীদের কুরুচিকর বক্তব্যের উপযুক্ত জবাব ভিডিওর মাধ্যমে দিয়ে থাকেন । পক্ষান্তরে কেউ ভিডিও বানানো কে অপছন্দ করেন । আজকের প্রবন্ধের মাধ্যমে নিরপক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সঠিক বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব । ইনশাআল্লাহ

অতিতের ছবি আর বর্তমান যুগের ডিজিটাল ছবির মধ্যে পার্থক্য কি?

পূর্বে মানুষের আকৃতি দুই ভাবে সংরক্ষণ করা হতো ।

  • মূর্তি তৈরি করে ।
  • ছবি অংকন করে।

মুশরিকরা মূর্তি ও ছবি তৈরি করত, ইবাদত করার জন্য ও সম্মান (তাজিম) এর জন্য । ইসলামী শরীয়তে প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা অথবা ছবি অংকন করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ।

আমাদের প্রিয়নবী রউফুর রহিম (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিনে ছবি বা মূর্তি নির্মাতাদের সর্বাধিক কঠিন শাস্তি হবে” (বুখারি ৫৯৫০, মুসলিম ২১০৯)

হাদীস শরীফের মধ্যে আরো রয়েছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) সফর হতে আসলেন, এমতাবস্থায় আমি একটি ছবিপূর্ণ পর্দা তাকের উপর দিয়ে রেখেছিলাম। রাসূল (ﷺ) তা দেখে ছিঁড়ে টুকরা করে দিলেন এবং বললেন, ‘যারা ছবি-মূর্তি অংকন করে ক্বিয়ামতের দিন তাদের কঠিন শাস্তি হবে’ (বুখারী ২/৮৮০ পৃঃ)।

মূর্তি তৈরি করা এবং ছবি অংকন করা বা ছবি তুলে প্রিন্ট করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। পৃথিবীর সমস্ত ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত। এর মধ্যে কোন প্রকার সন্দেহ নেই ।

এরপরেও বিশেষ প্রয়োজনে ওলামায়ে কেরাম ছবি তোলা কে জায়েজ বলেছেন। যেমন – আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট, বিভিন্ন ফর্ম ফিলাপ, প্যান কার্ড, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছবি তোলা । (এ কথাটুকু মনে রেখে সামনের দিকে পড়তে থাকুন)

ডিজিটাল ক্যামেরার ছবিঃ

ডিজিটাল ক্যামেরা বলতে এমন ক্যামেরা বোঝায়, যেগুলোতে সনাতনী ফিল্ম ব্যবহৃত হয় না, বরং তার বদলে মেমরী চিপের মধ্যে ছবি ধারণ করে রাখার ব্যবস্থা থাকে এবং সেই ছবি চাইলে কেউ প্রিন্ট করে বের করতে পারে (যা ইসলামের শরীয়তে জায়েজ নেই)। এর মধ্যে ফিল্ম আকারে কোন প্রকারের আকৃতি স্টোর হয় না । যদি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে, তার মধ্যে কোন প্রকার ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে না ।

এই ক্যামেরা মানুষের প্রতিচ্ছবি গ্রহণ করে এবং ছবিগুলো ক্যামেরাতে সংযুক্ত মেমরি কার্ডে সংরক্ষণ করে। মেমরি কার্ডে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের ফাইলের ফরম্যাট ব্যবহার করা হয়। সাধারণত BMP, JPG, TIFF , ইত্যাদি। হাতে ছবি অংকন করা এবং ডিজিটাল ক্যামেরা দ্বারা আকৃতি স্টোর করা, এই দুইয়ের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে ।

ডিজিটাল ভিডিও বানানো কি হারাম?

ডিজিটাল ক্যামেরা দ্বারা যে ভিডিও বানানো হয় তা হল, মানুষের একটি চলমান প্রতিচ্ছবি । আয়নার সামনে দাঁড়ালে মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে কিন্তু আয়না সেটা স্টোর করতে পারেনা । ডিজিটাল ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে মানুষের চলমান প্রতিচ্ছবি ক্যামেরা স্টোর করতে পারে । আয়না এবং ডিজিটাল ক্যামেরার মধ্যে শুধুমাত্র এতোটুকু পার্থক্য ।

হাদিসের মধ্যে প্রাণীর ছবি অংকন করতে নিষেধ করা হয়েছে । সেই ছবির সঙ্গে ডিজিটাল ছবি এবং ডিজিটাল ভিডিওর কোন সাদৃশ্য নেই । ডিজিটাল ক্যামেরার ছবি এবং ভিডিও সম্পূর্ণরূপে আলাদা । তাই ছবির সঙ্গে তুলনা দিয়ে ইসলামিক ডিজিটাল ভিডিও কে সরাসরি হারাম বলে ফতোয়া দেওয়া উচিত হবে না ।

সরাসরি ছবি অংকন করা বা প্রিন্ট করা হারাম হওয়ার পরেও ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রয়োজনের খাতিরে পাসপোর্ট, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ইত্যাদি ছবি তোলা জায়েজ । তাহলে সরাসরি হারাম প্রমাণিত না হওয়ার পরেও বাতিলপন্থী, ইসলামবিরোধী, নাস্তিকপন্থী মানুষদের উপযুক্ত জবাব দিয়ে ইসলামের স্বার্থে বিশেষ প্রয়োজনে ইসলামী ভিডিও বানানো কেন জায়েজ হবে না?

নিজের স্বার্থে যদি জায়েজ বলেন আর দ্বীন ইসলামের স্বার্থে যদি হারাম বলেন তাহলে এটা বড় বোকামি হবে।

ইসলামী ভিডিও বানানো কতটা জরুরী?

বর্তমানে ইসলাম বিরধীরা ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে চতুর্দিক থেকে মুসলিম জনতাকে ঘিরে ফেলেছে, দিনের পর দিন অপপ্রচার করে যাচ্ছে। এর বিপক্ষে মসজিদে, জলসায়, মিলাদে, প্রতিবাদ করলে তা বাতিল পন্থী, নাস্তিক্যবাদী, ইসলামবিরোধী মানুষের কর্ণ গ্রহরে পোঁছাবে না । তবে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভিডিও বানিয়ে উপযুক্ত জবাব দিলে তা দ্রুতগতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে ।

ইসলামিক ভিডিও বানিয়ে শুধু লাভই হবে, কোন প্রকার ক্ষতি হবে না। তবে যারা উপযুক্ত দলিল ছাড়া, শুধুমাত্র দুর্বল দলিল নিয়ে, আবেগে কথা বলেন তাদের ক্ষতি হবে । সেই জন্যই হয়তো তারা ভিডিও থেকে দূরে থাকতে চাইছেন ।

ইসলামী ভিডিও দেখে অসংখ্য যুবক পরিবর্তন হয়েছে । বর্তমানে ইসলামী ভিডিও না বানালে ক্ষতি রয়েছে। আর বানালে শুধু উপকার আর উপকার রয়েছে । তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামী ভিডিও বানানো শুধু জায়েজ নয়, বরং জরুরী ।

সেই কথা ভেবে বর্তমানে পৃথিবীর ৯৯.৯ শতাংশ সুন্নি স্কলার, মুফতি ও ওলামায়ে কেরামগণ ভিডিওর মাধ্যমে ইসলামের বাণী প্রচারকে সমর্থন দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেও ভিডিও করছেন । সকলের নাম নেওয়া সম্ভব নয় তবুও উদাহরণস্বরূপ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো-

(১) শায়েখ মোহাম্মদ আল-সারওয়াবী (ইসলামিক স্কলার, মিশর)
(২) ওয়াগদি গানিম (তুরস্ক)
(৩) সালাম আসরার রাশিদ (সিরিয়া)
(৪) তৌসিফ রেজা (পীর সাহেব, বেরেলী শরীফ)
(৫) মান্নান মিয়া (পীর সাহেব, বেরেলী শরীফ)
(৬) তৌকির রেজা (মাওলানা, বেরেলী শরীফ)
(৭) সায়েদ হাশমি মিয়া (বিখ্যাত বক্তা)
(৮) মুফতি আমিনুল কাদরী (বিখ্যাত বক্তা)
(৯) মুফতি মোহাম্মদ আকমাল (ইসলামিক স্কলার)
(১০) পীর সাকিব সামী ( দাওয়াতি সংগঠন কানজুল হুদার প্রতিষ্ঠাতা)
(১১) হানিফ কুরাইশী (বিখ্যাত বক্তা)
(১২) ইলিয়াস আক্তার কাদরী (দাওয়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা)
(১৩) কাউকাব নুরানী (বিখ্যাত বক্তা)

এমন অসংখ্য ইসলামী স্কলার, মুফতি ও মৌলানা পৃথিবীর জমিনে বিভিন্ন দেশে রয়েছে। প্রত্যেকের অসংখ্য ভিডিও বর্তমানে ইউটিউবে আছে এবং অনেকেই টিভিতে প্রোগ্রাম করছেন ।

তাই আমরা যদি কুয়োর ভিতর বসে থেকে সব বিচার করতে চাই তাহলে তো হবে না। জগৎটার দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে । তাহলে বোঝা যাবে আমাদের ভুল হচ্ছে। নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করা, নিজেকে বড় বানানোর উদ্দেশ্যে নিজের সিদ্ধান্ত অটল থাকা খুব ভালো কাজ না ।

ইসলামিক ভিডিও বিরোধীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন, উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো ।

(১) ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ছবি তোলা জায়েজ হলে,দ্বীন ইসলাম প্রচারের খাতিরে ভিডিও বানানো কেন জায়েজ হবে না?

(২) বিভিন্ন মসজিদে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন মাজারে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা লাগানো হয় যেখানে ভিডিও হয় সে সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?

(৩) বাজার, শপিং মল, রেল স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, এয়ারপোর্ট, ইত্যাদি প্রায় সব জায়গাতেই ভিডিও হয়ে থাকে । যার মাধ্যমে নজর দারি রাখা হয় । এমনকি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আপনি ঘরের বারান্দায় থাকলেও আপনার ছবি উঠে যায় । এখন আপনি পৃথিবী থেকে চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে চলে যাবেন, নাকি মাটি খুঁড়ে গভীরে বাসা নির্মাণ করবেন?

(৪) বাতিল ফিরকা অসংখ্য সেনাবাহিনী নিয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আপনি তাদের মোকাবেলা কিভাবে করবেন ?

(৫) অধিকাংশ উলামা যে বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন সেটা আপনি মানবেন নাকি আংশিক ওলামা যা বলেছেন সেটা মানবেন?

(৬) যেকোনো বিষয়ে দলিল দেওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আহমেদ রেজা (রহঃ) মতো উত্তর কেন দেন না ? তিনি প্রথমে কোরআনের আয়াত, তারপর হাদিস, তারপর ইমামদের মতামত, তারপর বিভিন্ন মহাদ্দিসিন ও মুফাসসিরিনদের মতামত পেশ করতেন । আপনারা সেই পথ ফলো করছেন না কেন?

(৭) পৃথিবীজুড়ে যে সমস্ত সুন্নি স্কলার,ওলামা, মুফতি ভিডিও করছে বা যারা সমর্থন করেছে তারা কি সবাই ফাসেক এবং হারামখোর?

যারা ভিডিওর মাধ্যমে ইসলামের খেদমত করাকে হারাম বলছেন তাদের কাছে আমার এই প্রশ্নগুলি থাকলো । যদি যথাযথ দলিল ও যুক্তি দ্বারা উত্তর দিতে পারেন তো দিবেন না হলে মুখে তালা লাগিয়ে চুপ থাকাই উত্তম হবে।

আব্দুল আজিজ কাদেরী

Spread the love

Leave a Comment