সূরা ইয়াসিন ও সূরা মুল্ক এর ফযিলত ও গুরুত্ব

সূরা ইয়াসিন ও সূরা মুল্ক এর ফযিলত ও গুরুত্ব

মহান রাব্বুল আলামীন প্রেরিত নবী-রসূলগণের (আলায়হিমুস্ সালাম) ওপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ও সহীফা সমূহ’র মধ্যে প্রিয় নবী ইমামুল আম্বিয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন’র ওপর নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ ক্বোরআনুল করীম হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। পবিত্র ক্বোরআন মজীদ পাঠ করা ও শিক্ষা দেয়ার মধ্যে অগণিত ফযিলত, রহমত ও বরকত রয়েছে। এটা সর্বশ্রেষ্ঠ শেফা।

আমীরুল মুমিনিন হযরত ওসমানগণী জিন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- ‘‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি যে ক্বোরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা প্রদান করে।’’ [বুখারী শরীফ]

হযরত আবু মুসা আস্আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে মুমিন ব্যক্তি ক্বোরআন পাঠ করে তার উপমা হচ্ছে কমলা লেবুর মতো, খুশবুও ভাল এবং স্বাদও রুচিসম্মত। আর যে মুমিন ক্বোরআন পাঠ করে না সে খেজুরের ন্যায়। এর মধ্যে খুশবু নেই, তবে স্বাদে মিষ্ট, আর যে মুনাফিক্ব ক্বোরআন পাঠ করে, সে ফুলের ন্যায়-সেটার মধ্যে খুশবু আছে কিন্তু স্বাদে তিক্ত। [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]

পবিত্র ক্বোরআন মজীদের গুণাগুণ বর্ণনার জন্য উপরোক্ত দু’টি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ক্বোরআনুল করীমের ফযিলত, বরকত সম্পর্কে বর্ণনা করতে গেলে বিশ্বের সমুদয় পানি ও সমস্ত গাছ-বাঁশকে কালি এবং কলম বানালেও এটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ মহাগ্রন্থের গুণাগুণ সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু অধিক জ্ঞাত।
পবিত্র ক্বোরআন করীমের একটি হরফ পাঠ করলে দশটি সওয়াব পাওয়া যায়। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত প্রত্যহ কিছু না কিছু পরিমাণ ক্বোরআন তেলাওয়াত করা। এ মহাগ্রন্থের মধ্যে বিশেষ কিছু আয়াতে করীমা ও সূরা বিদ্যমান যা পাঠে বিশেষ মর্যাদা ও অনুগ্রহ লাভ করা যায়। অনেক আয়াতে করীমা ও সূরার মধ্যে আজকে একটি সূরার আংশিক ফযিলত, বরকত ও মর্যাদার উদ্ধৃতি দেয়া হলো-

সূরা ইয়াসিন

* এ সূরা ২২ পারার শেষাংশ ও ২৩ পারার প্রথমাংশ জুড়ে অবস্থান করছে। এর আয়াত সংখ্যা ৮৩ ও রুকূ’ হলো ৫টি। ক্বোরআন করীম নাযিলের ধারাবাহিকতায় ৪১ নম্বরে এ সূরা অবতীর্ণ হয়।

* এ সূরার ৯ নম্বর আয়াতে করীমা ‘‘ওয়া জা’আলনা মিম্ বাইনি আইদীহিম সাদ্দাওঁ ওয়ামিন খালফিহিম সাদ্দান ফাআগশাইনা-হুম ফাহুম লা-ইয়ুবসিরূ-ন।’’ অর্থাৎ আর আমি তাদের সম্মুখে প্রাচীর স্থাপন করেছি এবং তাদের পেছনে একটা প্রাচীর। আর তাদেরকে উপর থেকে আবৃত করে দিয়েছি; সুতরাং তারা কিছুই দেখতে পায় না।’’
এখানে হুযূরের বিরোধীতাকারীদের গায়েবী শাস্তি প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। নবী বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে গৃহীত বিভিন্ন শাস্তিমুলক ব্যবস্থার মধ্যে এটা একটা কঠোর সতর্কবাণী।

শানে নুযূলঃ

* এ আয়াত শরীফ আবূ জাহ্ল ও তার দু’জন মাখযুমী বন্ধুর প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। আবু জাহল এ মর্মে শপথ করেছিলো যে, ‘যদি আমি মুহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)কে নামায পড়তে দেখি, তবে তাঁর মাথা ভেঙ্গে ফেলবো (নাঊযুবিল্লাহ্)। যখন সে হুযূরকে নামায পড়তে দেখলো, তখন এক প্রকান্ড পাথর নিয়ে হুযূরের দিকে অগ্রসর হলো। যখন হুযূরের নিকট পৌঁছলো, তখনই তার হাত গর্দানে আটকা পড়ে গেলো। আর পাথরটি তার হাতে লেগে রইল। সোবহানাল্লাহ্!
আবু জাহলের এ অবস্থা দেখে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা বললো, ‘এ কাজটি আমি করবো।’ যখন সে পাথর নিয়ে অগ্রসর হলো, তখন সে অন্ধ হয়ে গেলো, হুযূরকে দেখতে পায়নি। তৃতীয় ব্যক্তি বললো, ‘পাথরটা আমাকে দাও।’ সেও পাথর নিয়ে অগ্রসর হলো। হঠাৎ সে দিশেহারা হয়ে উল্টো পায়ে দৌঁড়ে পালালো। সে বললো এক প্রকান্ড ষাঁড় আমার সম্মুখভাগে ছিলো। যদি আমি সামনে অগ্রসর হতাম তবে সেটা আমাকে মেরে ফেলতো।’ আলোচ্য আয়াতে এ বর্ণনা রয়েছে (খাযাইন ও জুমাল দ্রষ্ট্রব্য: কানযুল ঈমান ও তাফসীরে নুরুল ইরফান।) আল্লাহ্ জাল্লাহ্ শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবের বিরুদ্ধবাদীদের কতো কঠোর শাস্তি দেবেন তা অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয়। নবী বিদ্বেষীগণের জন্য এ আয়াতে করীমা কঠোর সকর্তবাণী।

আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী করীম রাউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমান: প্রত্যেক বস্তুরই প্রাণ (রূহ) আছে। ক্বোরআনের প্রাণ সূরা ইয়াসিন। আমার ইচ্ছা প্রত্যেক উম্মতের হৃদয়ে সূরা ইয়াসিন বিদ্যমান থাকুক।

* এ সূরা নিয়মিত পাঠে ২০টি বরকত লাভ হয়। ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা ও পিপাসার্তের পিপাসা নিবারণ, বস্ত্রহীনের বস্ত্রপ্রাপ্তি, অবিবাহিতের বিবাহ্, পীড়িত ব্যক্তি সুস্থ হয়, ভয়ভীতি থাকেনা, বন্দীর মুক্তি লাভ হয়, মুসাফির নিরাপত্তা ও গায়েবী সাহায্য পায়, দরিদ্র ধনী হয়, ঋণগ্রস্থের ঋণ পরিশোধ হয়, হারানো বস্তু পাওয়া যায় ইত্যাদি।

* এ সূরা একবার পাঠে ১০ খতম এবং নামাযে পড়লে ১০০ এবং জামাতে পড়লে ২৭০০ খতমের সাওয়াব পাওয়া যায়।

* এ সূরা প্রত্যহ একবার পাঠ করলে তার সকল অভাব দূর হবে।

* এ সূরা রাত্রে পড়লে সমস্ত গুনাহ্ মাফ (ক্ষমা) হয়। এভাবে নিয়মিত পড়লে এ সূরা কিয়ামতের ময়দানে তার (পাঠকারী) জন্য সুপারিশ করবে এবং কবরস্থানে দাঁড়িয়ে পড়লে কবরবাসীর কবর আযাব বন্ধ হয়। [আল হাদীস]

* এ সূরা প্রসূতীকে পাঠ করে শুনালে সহজে সন্তান প্রসব হবে এবং মুমূর্ষ ব্যক্তির শিয়রে পড়লে মৃত্যু-যন্ত্রণা লাঘব হয়।

* নিয়মিত পাঠে রোজ কিয়ামতে তাঁর (পাঠকারী) সুপারিশে রবি‘আহ্ ও মোদ্বার গোত্রের লোক অপেক্ষা অধিক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খোলা থাকবে এবং আল্লাহ্ পাকের দরবারে ‘শরীফ’ নামে অভিহিত হবে। [রূহুল মা‘আনী] এ সূরা জাফরান দিয়ে লিখে তা ধৌত করে পান করলে স্মরণ শক্তি বাড়ে, তর্কে বিজয়ী হয়, স্তন্যধাত্রী মায়ের দুগ্ধ বৃদ্ধি পায়, বন্ধ্যাস্ত্রীলোকের সন্তান লাভ হয়।

* রাত্রে এ সূরা পড়ে কেউ মারা গেলে শাহাদাতের দরজা লাভ করবে।

* পাঁচবার এ সুরা পড়ে কোন বড় অফিসারের নিকট গেলে সম্মান পাওয়া যায় এবং স্বীয় উদ্দেশ্য সফল হয়।

* মুর্জারাবাত কিতাবে বর্ণিত আছে, মনযোগের সাথে এ সূরা ৪১ বার পাঠ করলে যে কোন সদিচ্ছা ইন্শা-আল্লাহ্ পূর্ণ হবে।

* এ সূরার ৭ স্থানে ‘মুবীন’ শব্দটি আছে, প্রথম মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ, আবার প্রথম থেকে দ্বিতীয় মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ, আবার প্রথম মুবীন থেকে তৃতীয় মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ, আবার প্রথম থেকে চতুর্থ মুবীন পড়ে এক ফুঁ, প্রথম থেকে পঞ্চম মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ, আবার প্রথম থেকে ষষ্ঠ মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ, আবার প্রথম থেকে সপ্তম মুবীন পর্যন্ত পড়ে এক ফুঁ কালজিরায় দিয়ে খেলে যে কোন কঠিন রোগ অল্প দিনের মধ্যে সেরে যায়।

* সূরা ইয়াসিন পাঠে আরো বহু ফায়দা রয়েছে যা লিখে শেষ করা যাবে না।

সূরা মূল্ক

আল ক্বোরআনের ধারাবাহিকতায় ৭৭ নম্বরে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। আয়াতে করীমার সংখ্যা-৩০ এবং রুকূ’- ২।

* এ সূরার বড় ফযিলত রয়েছে। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান: ‘‘এ সূরা সুপারিশ করবে। কবরের আযাব থেকে নাজাতেরও কারণ হবে।’’ একজন সাহাবী জঙ্গলে মাটির ভিতর সূরা মূলক পড়ার আওয়াজ শুনতে পান। ঘটনা হুযূরের দরবারে আরয করলেন। হুযূর এরশাদ ফরমালেন, ‘‘সেখানে এমন একজন মুমিনের কবর রয়েছে, যে তার জীবদ্দশায় সূরা মূলক শরীফ পাঠ করতো, এখনো কবরে পাঠ করছে। ’’

* এ সূরার ১০ নম্বর আয়াতে ‘ওয়াক্বা-লু-লাউ কুন্না- নাসমা‘উ আউনা’ক্বিলু মা-কুন্না- ফি আসহা-বিস্ সা‘ঈর।’ অর্থ: এবং বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বুঝতাম তবে দোযখবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না।
এই আয়াতে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি চক্ষু-কর্ণ সম্পর্কে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। বুঝা গেলো যেই বিবেক বুদ্ধি দ্বারা দ্বীন বুঝা যায় না তা হচ্ছে বিবেক ও বুদ্ধিহীন তাই। যে কান ও চোখ নবীর বিধানাবলী শোনে না ও আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখে না সেগুলি বধির ও অন্ধ। যদি পার্থিব বিষয়াদিতে কাজে আসে। এটা আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষাণীয় বিষয়। [কানযুল ঈমান ও নুরুল ইরফান]

* সূরা মূলক নিয়মিত পাঠ করলে হাশরের দিন পাঠককে মাফ না করা পর্যন্ত এ সূরা আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে থাকবে।

* নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাতেই সূরা মূলক পড়ে তারপর নিদ্রা যেতেন।
[তিরমিযী শরীফ]

* প্রত্যহ তিনবার করে একাধারে তিনদিন এ সূরা পড়ে চোখে ফুঁক দিলে চক্ষু রোগ নিবারণ হয়।

* নিদ্রা যাবার পূর্বে এ সূরা পাঠ করলে তেলাওয়াতকারীর অফুরন্ত সওয়াব হয় এবং কবর আযাব মাফ হয়। কবর যিয়ারতের সময় এ সূরা পাঠ করলে কবর আযাব বন্ধ হয়। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- প্রত্যেক মুসলমান এ সূরাটি মুখস্থ করলে তারা খুবই উপকৃত হবে।

* এ সূরা স্বপ্নে পড়তে দেখলে নেক আমলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অগাধ ধন সম্পদের মালিক হবে।

* এ সূরা খালেস নিয়তে ৪১ বার পড়লে আল্লাহর কৃপায় তার সকল বালা-মুসিবত দূর হয়। ইনশাআল্লাহ্!

এ সূরা পাঠে এতদ্ব্যতীত আরো অনেক ফযিলত রয়েছে। প্রত্যেক মুমিন বান্দার উচিত প্রতিদিন ক্বোরআন মজীদের অন্তত এক রুকূ’ হলেও পাঠ করা। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের আমল করার তাওফিক দিন। #আমীন।

Spread the love

Leave a Comment