আযানে নবী (সাঃ) এর নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন করা কি জায়েজ?

আযানে নবী (সাঃ) এর নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বনের বিধান

আযান ও ইক্বামতে أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّه (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্) বলার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন করে তা উভয় চোখে মাসেহ করা উত্তম কাজ। রাসূলে করীমের প্রতি পরম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে রাসূল প্রেমের অমৃত সুধাপানকারী প্রেমিকগণ পরিপূর্ণ ভক্তি ও সম্মানের সাথে এ আমল করেন। সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে অদ্যাবধি এ মুস্তাহাব আমলটি চলে আসছে। বর্তমানে এ মুস্তাহাব আমলকে একশ্রেণীর লোক বিদ‘আত তথা মন্দ বিদ‘আত বলে অপপ্রচার চালিয়ে সরলমনা মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এ নেক আমলটি হাদীস শরীফ ও উলামায়ে কিরামের স্বীকৃতির মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে প্রমাণিত। এ আমলটি হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। কোন আমল হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হলে, তা কারো মতে, মন্দ বিদ‘আত হতে পারে না। সুতরাং এ আমলটিও মন্দ বিদ‘আত নয়; বরং মুস্তাহাব আমল, যা রাসূলে করীমের নৈকট্য অর্জনে সহায়ক।

হাদীস শরীফের আলোকেঃ

আযান ও ইকামতে اشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًارَّسُوْلُ اللّٰهِ (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ) বলার সময় সায়্যিদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি মতান্তরে শাহাদাত আঙ্গুলিযুগলের অগ্রভাগে চুমু দিয়ে উভয় চোখে মাসেহ করতেন।

এ প্রসঙ্গে ইমাম সাখাভী আলাইহির রাহমাহ্ বলেন-

أَنَّهُ لَمَّا سَمِعَ قول المؤذن أشهد أن محمد رَسُولُ اللَّه قَالَ هَذَا، وَقَبَّلَ بَاطِنَ الأُنْمُلَتَيْنِ السَّبَّابَتَيْنِ وَمَسَحَ عَيْنَيْهِ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ فَعَلَ مِثْلَ مَا فَعَلَ خَلِيلِي فَقَدْ حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِي

“সায়্যিদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মুয়াজ্জিনের ধ্বনি “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ” শুনে এ দোয়া পড়তেন এবং শাহাদাত আঙ্গুলদ্বয়ের অগ্রভাগে চুমু দিয়ে উভয় চোখে মাসেহ করতেন। এ আমল দেখে রাসূলে করীম ইরশাদ করেন-

مَنْ فَعَلَ مِثْلَ مَا فَعَلَ خَلِيلِي فَقَدْ حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِي  “যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর মত আমল (বৃদ্ধাঙ্গুলি চুমু খেয়ে চোখে মাসেহ) করবে, তার জন্য আমার শাফায়াত প্রযোজ্য হবে।

” আমলটি প্রথমে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) স্বেচ্ছায় করলেও, তা একান্ত তাঁর আমল হিসেবে সীমিত থাকেনি বরং রাসূলে করীম তাঁর এ আমলকে সমর্থন করার কারণে আমলটি রাসূলের মারফু’ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ এ আমল এখন রাসূলের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং এ হাদীসের আমল বাস্তবায়ন হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)র জীবনে।

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলও উম্মতে মুহাম্মাদ্দীর জন্য অনুসরণযোগ্য। কারণ রাসূলে করীম ইরশাদ করেন- عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ مِنْ بَعْدِي وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ “আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী হেদায়তপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ কর এবং তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধর।” সুতরাং যে আমল ইসলামের প্রথম খলীফা করেছেন এবং তা রাসূলে করীম সমর্থন করেছেন, তা করতে কোন বাঁধা নেই, বরং সাওয়াব রয়েছে।

যে আমল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, তা বিদ‘আত বলারও কোন অবকাশ নেই। আর যারা এ হাদীসের সূত্রের দূর্বলতার কারণে আমলটি করতে বাধা দেয়, তাঁরা হয়তো জানে না যে, দুর্বল সনদের হাদীসের ওপর আমল বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কিরাম একমত হয়েছেন। তাছাড়া কোন কাজ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে দলীল প্রয়োজন হয় না। কারণ কোন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার কোন দলীল না থাকলে বা কোন নতুন আমল কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী না হলে, তা বৈধ। তবে নাজায়েজ হওয়ার জন্য কুরআন-সুন্নাহর দলীল থাকা প্রয়োজন।

আঙ্গুল চুম্বন নাজায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কোন দলীল নেই। অত-এব আযান ও ইকামতে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ” বলার সময় দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় মতান্তরে শাহাদাত আঙ্গুলদ্বয়ের অগ্রভাগে চুমু দিয়ে উভয় চোখে মাসেহ করা হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের আমল, যা নিঃসন্দেহে মুস্তাহাব ও ভালো উপকারী আমল।

ওলামায়ে কিরামের ফাতাওয়া
এ আমলকে যুগ যুগ ধরে উলামায়ে কিরাম স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। নিন্মে কয়েক জনের অভিমত উল্লেখ করা হলোঃ

১. বিশ্ববিখ্যাত হানাফী ফাতাওয়ার কিতাব ‘রাদ্দুল মুহতার আলাদ্ দুররিল মুখতার’-এ ইমাম শামী আলাইহির রাহমাহ্ বলেন-
“মুস্তাহাব হল, যখন আজানের ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ এ প্রথম চরণ বলতে শুনবে, তখন ‘সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলবে এবং দ্বিতীয় চরণ যখন বলতে শুনবে তখন বলবে, قُرَّةُ عَيْنِي بِك يَا رَسُولَ اللَّهِ (র্কুরাতু আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ) বলবে। অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুলিযুগলের নখ উভয় চোখের উপর রেখে বলবে اللَّهُمَّ مَتِّعْنِي بِالسَّمْعِ وَالْبَصَرِ (আল্লাহুম্মা মাত্তি’নী বিসসামই ওয়াল বাসরি)। আর যে এ আমল করবে, রাসূলে করীম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।”

২. হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘মুখতাসারুল বিকাইয়া’ গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ভাষ্যগ্রন্থ ‘জামের্উ রুমুয’ গ্রন্থকার ইমাম আব্দুল আলী বরজন্দী তাঁর ভাষ্যগ্রন্থে বলেন-
“জেনে রাখুন, অবশ্যই মুস্তাহাব যে, যখন আজানের প্রথম ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ বলতে শুনবে, তখন صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ (সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ) বলবে এবং দ্বিতীয় চরণ যখন বলতে শুনবে তখন বলবে, قُرَّةُ عَيْنِيْ بِكَ يَا رُسُوْلَ اللَّهِ (র্কুরাতু আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্) বলবে। অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুলিযুগলের নখ উভয় চোখের উপর রেখে اَللَّهُمَّ مَتِّعْنِيْ بِالسَّمْعِ وَالْبَصْر (আল্লাহুম্মা মাত্তি’নী বিস্সামই ওয়াল বাস্রি) বলবে। কেননা যে ব্যক্তি এ আমল করবে, রাসূলে করীম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। এভাবে ‘কানযুল ইবাদ’ গ্রন্থে রয়েছে।”

৩. শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা জামাল বিন আব্দুল্লাহ ওমর মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ফাতওয়ায় বর্ণনা করেন-
“আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারক শুনে আঙ্গুল চুম্বন করে তা চোখে লাগানো জায়েয কিনা? আমি এসব বাক্যে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, আজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র নাম মুবারক শুনে আঙ্গুল চুম্বন করে চোখে লাগানো জায়েয, বরং মুস্তাহাব। আমাদের মাযহাবের বিজ্ঞ মাশায়েখগণ তাঁদের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে এ আমলকে মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন।”

. মোল্লা আলী কারী আলায়হির রাহমাহ তার সর্বজন প্রহণযোগ্য ‘আল-মাওদ্বুআতুল কুবরা’ গ্রন্থে বলেন- “আঙ্গুল চুম্বনের হাদীসটি হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক ‘মারফু’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বিধায়, এ হাদীসের ওপর আমলের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতের উপর আমল করা তোমাদের উপর আবশ্যক’।” আঙ্গুল চুম্বন বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারীর জোরালো সমর্থন রয়েছে। এ জন্য তিনি আঙ্গুল চুম্বনের হাদীসটি আমলের জন্য যথেষ্ট বলার পর এ আমল বৈধ হওয়া প্রসঙ্গে অন্য হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেছেন।

৫. মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা আবুল হাসান বলেন-
“হযরত খাদ্বির আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের ধ্বনি ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মার্দা রাসূলুল্লাহি’ বলার সময়ে ‘মারহাবান বিহাবীবী ওয়া র্কুরাতু আইনী মুহাম্মাদিব্নি আব্দিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলে, (সর্বদা) তার বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বুন করে তার উভয় চোখে রাখবে, সে কখনো অন্ধ হবে না এবং তার চোখ উঠবে না।”

. মালেকী মাযহাবের ফকীহ ‘কিফাইয়াতুত্ ত্বালেবীন’ গ্রন্থকারের ভাষ্যকার আল্লামা আলী ইবন আহমাদ আদাবী বলেন- “বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয়ের কোন অংশে চুমু দিতে হবে তা ‘কিফাইয়াতুত্ তালেবীন’ গ্রন্থকার স্পষ্ট করে বর্ণনা করেননি। তবে তিনি সর্বজনবিদিত মুফাসসির শাইখ নূরুদ্দিন খুরাসানী সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘আযানের সময়ে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে। তিনি মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মার্দা রাসূলুল্লাহ’ শুনে স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয়ে চুমো দিলেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয়ের নখের পৃষ্ঠদেশ দিয়ে উভয় চোখের কোণ থেকে শুরু করে পুরো চক্ষুদ্বয়ের ওপর মাসেহ করেন। অতপর প্রতি আজানের ‘তাশাহ্হুদের সময়ে তিনি এভাবে বারংবার তা করতেন। এ প্রসঙ্গে আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি পূর্বে এ আমল করতাম। পরে আমি এ আমল ত্যাগ করেছি। এ অবস্থায় আমার চোখদ্বয় অসুস্থ হয়ে গেছে এবং আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছি যে, তিনি আমাকে বলেন, তুমি আজানের সময়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি চুমো খেয়ে তা চোখে মাসেহ করা কেন ত্যাগ করেছো? যদি তুমি তোমার চোখের সুস্থতা চাও, তাহলে মাসেহ করার আমলটি পুনরায় শুরু কর। আমি ঘুম থেকে জেগে আমলটি শুরু করে দিয়েছি। এতে আমার চক্ষুদ্বয় ভাল হয়ে গেল আর চক্ষুদ্বয় অদ্যাবধি অসুস্থ হয়নি। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, এ আমল সর্বদা করা উত্তম আর বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয়ের নখের পৃষ্ঠাদেশের ওপরে চুমো দিয়ে তা মাসেহ করার বিষয়টি সুস্পষ্ট।”

পর্যালোচনাঃ

উল্লিখিত আলোচনা থেকে কী বোঝা গেল-তা না বোঝার কথা নয়। কোন আমল বৈধ হওয়ার জন্যে যা প্রয়োজন, তা এ আমলের মধ্যেও রয়েছে। প্রথমত এ আমলটির বৈধতা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আবার ‘ফাতাওয়ায়ে শামি’সহ একাধিক বিশ্ববিখ্যাত ফাতাওয়ার কিতাবের ফতোয়া দ্বারাও প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত এ আমলটি অবৈধ হওয়ার তো কোন দলীল-প্রমাণ নেই। তাহলে কারো কারো কাছে এ আমলটি অবৈধ কেন মনে হয়?

তাদের কাছে এ আমল অবৈধ মনে হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে।

এক. এটি সহীহ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নয়।

দুই. এটি দ্বয়ীফ হাদীস আর দ্বয়ীফ হাদীসের ওপর আমল করা বৈধ নয়।

তিন. এটি বিদআত আর যে কোন বিদআত সদাই বর্জনীয়।

তাদের কাছে মূলত এ তিন কারণেই এ আমলটি পালনীয় নয়; বরং বর্জনীয়।  প্রথমত তারা মনে করে যে, সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কোন প্রকার হাদীসের ওপর আমল করা যাবে না। তাদের এ কথা সঠিক নয়। কারণ আমলের জন্যে শুধু সহীহ হাদীস হতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই বরং আমলযোগ্য হাদীস শরীফ হলেই হবে। আর মুহাদ্দিসগণের মতে আমলযোগ্য হাদীস হল-

১.মুতাওয়াতির’ ২ ‘সহীহ লিযাতিহি’, ৩.সহীহ্ লিগাইরিহি  ৪.হাসান লিযাতিহি ৫.‘হাসান লিগাইরিহি ও ৬.জয়ীফ’

এ কথার ওপর সকলেই একমত। প্রাথমিক যুগ থেকে অদ্যাবধি উলামায়ে কিরাম এ নীতির ওপরই আমল করে আসছেন। বর্তমানে বিচ্ছিন্ন কতিপয় ব্যক্তি আমল করার জন্যে শুধু ‘সহীহ হাদীস’ই মানে এবং মনে করে, অন্য কোন প্রকার হাদীস আমলযোগ্য নয়। তাদের এ রকম ধ্যান-ধারণার কারণেই মূলত সমস্যা হচ্ছে। কারণ তারা সহীহ হাদীস ছাড়া আর কিছুই চিনে না। তাদের এমন চিন্তা-ধারা ও মানসিকতা মূলত জ্ঞানস্বল্পতারই পরিচায়ক। কেননা হাদীস বিশারদগণ ‘সহীহ হাদীস’কে যেভাবে আমলযোগ্য বলেছেন, সেভাবে অবশিষ্ট পাঁচ প্রকার হাদীসকেও আমলযোগ্য বলেছেন। এক কথায় তাঁদের মতে, আমলযোগ্য হাদীস উল্লিখিত ছয় প্রকার। যারা বলছে, শুধু ‘সহীহ হাদীস’র ওপর আমল করা যাবে আর অন্য কোন হাদীসের ওপর আমল করা যাবে না। তাহলে তারা হাদীস বিশারদদের ‘নীতি’ মানে না।
উল্লেখ্য, ‘সহীহ হাদীস’র পরিচয় আলেমগণের না জানার কথা নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে অনেকে বলে থাকে যে, ‘সহীহ হাদীস’ মানে শুদ্ধ হাদীস আর ‘গায়রে সহীহ’ বা ‘সহীহ নয়’ অর্থ অশুদ্ধ বা ভুল হাদীস। সুতরাং অশুদ্ধ বা ভুল হাদীসের ওপর কিভাবে আমল করা যাবে? তাদের কথায় অনেকে কান দেয়। আসলে এটা একটা চক্রান্ত। কারণ ‘সহীহ’ শব্দটি আরবী। এর একাধিক ব্যবহারিক অর্থ রয়েছে। যেমন শুদ্ধ, নির্ভুল, সুস্থ ইত্যাদি। যদি বলা হয় যে, ‘তোমার আরবী বাক্যটি সহীহ’- তাহলে এর দ্বারা বোঝাবে যে, এ বাক্যটি নির্ভুল বা শুদ্ধ। আর যদি বলা হয় যে, ‘তোমার আরবী বাক্যটি সহীহ নয়’- তাহলে এর দ্বারা বোঝাবে যে, এ বাক্যটি ভুল বা অশুদ্ধ। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে ‘সহীহ’ শব্দটি শুদ্ধ বা নির্ভুল অর্থে ব্যবহৃত হয় না; বরং এটি হাদীস শাস্ত্রের একটি পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর ‘সহীহ’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ হল- যে হাদীসের সূত্র নিরবচ্ছিন্ন, যার বর্ণনাকারীগণ সকলেই আদিল ও নির্ভরযোগ্য এবং যেটি শাযও নয়, কোন গোপন দূষে দূষিতও নয়, সেই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলা হয়।

এ জন্যে কোন হাদীসের ব্যাপারে যদি বলা হয় ‘এটি সহীহ হাদীস’ (হাযা হাদীসুন সহীহুন), তাহলে এর অর্থ হবে- হাদীসটি হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা অনুযায়ী সহীহ। আর যদি বলা হয়, ‘হাদীসটি সহীহ নয়’, তাহলে এর অর্থ হবে- হাদীসটি হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা অনুযায়ী সহীহ নয়। হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যখন বলেন, ‘হাদীসটি সহীহ’ নয়, তখন এ বাক্যের অর্থ হাদীসটি অশুদ্ধ বা ভুল নয়, বরং হাদীসটি পারিভাষিক ‘সহীহ’ নয়; বরং অন্য প্রকারের হাদীস তথা ‘হাসান’ বা ‘দ্বয়ীফ’ ইত্যাদি।

সুতরাং ‘সহীহ হাদীস’ ছাড়া অন্য প্রকার হাদীসের ওপর আমল করা যাবে না- এমন কথা নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কিরামের কেউ বলেন নি। তাহলে মিথ্যা কথা প্রচার করে নেক আমল থেকে যারা সরলমনা মুসলিমকে বিরত রাখে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার।

দ্বিতীয়ত তাদের দাবী হল- এটি দ্বয়ীফ হাদীস, যা আমলযোগ্য নয়। শুরু থেকে অদ্যাবধি সকল নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কিরাম বিশেষকরে মুহাদ্দিসগণ যেমন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুস সালাহ্, ইমাম নাওভী, ইমাম ইবন্ হাজর আসকালানী, ইমাম সুয়ূতী, মুল্লা আলী কারী, আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী, (আলাইহিমুর রাহমাহ্) ড. মাহমূদ তাহ্হান প্রমুখ তাঁদের স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, আমলের ক্ষেত্রে দ্বয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া যারা এ কথা বলে, তারা নিজেরাই তাদের ইমামের অনুসরণে দ্বয়ীফ হাদীসের ওপর আমল করছে। বক্ষের ওপর হাত বাঁধার ব্যাপারে আলবানী যে হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন তাও ‘দ্বয়ীফ’। আলবানী স্বীয় কিতাব ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিল দ্বয়ীফাহ ওয়াল মাওদুয়াহ’ গ্রন্থে উল্লিখিত হাদীসকে দ্বয়ীফ বলেছেন। এ হাদীসটি তাদের কাছে দ্বয়ীফ হওয়ার পরও তারা এ দ্বয়ীফ হাদীসের ওপর আমল করছে। অপরদিকে সরলমনা মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করছে।

তৃতীয়ত তাদের দাবী হল- এ আমল বিদআত। তাদের এ দাবী একেবারে অমূলক। যে আমলের অস্তিত্ব হাদীসে এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে রয়েছে, তা কিভাবে বিদআত হতে পারে? যেহেতু তারা বলে, এ আমল দ্বয়ীফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তা কখনো বিদআত হতে পারে না।

তথ্যসূত্রঃ-
দোয়াটি হচ্ছে-

أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ باللَّه رَبًّا، وَبِالإِسْلامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيًّا

১ (ইমাম সাখাভী, ‘আল-মাকসিদুল হাসানাহ’, বৈরুত: দারুল কিতাবিল আরাবী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৫ হি.) পৃ.৬০৫)

২ ইমাম সাখাভী, ‘আল-মাকসিদুল হাসানাহ’ (বৈরুত: দারুল কিতাবিল আরাবি,১ম সংস্করণ,১৪০৫হি.) পৃ.৬০৫;

৩ ত্বাহাভী, ‘শরহে মা‘আনিল‏ আ’ছার,(বৈরুত: মুয়াচ্ছাসাতুর রিসালাহ্, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫হি.) খ.৩, পৃ. ২২৩।

৪ শামী, ‘রাদ্দুল মুহতার, (বৈরুত: দারুল ফিকর, ২য় সংস্করণ,১৪১২হি.) খ. ১ম, পৃ. ৩৯৮।

৫ আব্দুল আলী বরজন্দী, জামেউর রুমুয্, খ. ১ম, পৃ.৭৭।

৬ ইমাম আহমদ রেযা, আল-ফাতাওয়া র্আ-রিজভিয়্যাহ্, খ. ৫ম, পৃ. ৪৩৬।

৭ মোল্লা আলী ক্বারী, ‘আল-মাওদ্বুয়াতুল কুবরা’ (বৈরুত : মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ্, ১৩৯১হি.) পৃ.৩১৬।

৮ আবুল হাসান, ‘কিফায়াতুত্ব ত্বালীব,(বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৪১২হি.) খ. ১ম, পৃ.৩২২-৩২৩।

৯ আলী আদাবী, ‘হাশিয়াতুল আদাবী আলা শরহি কিফায়াতিত্ ত্বালীব’(রৈবুত: দারুল ফিকর,১৪১৪হি.) খ. ১, পৃ.২৫৬-২৫৭।

১০ আবু বকর ওসমান দিমইয়াতী, ‘ইয়ানাতুত তালেবীন’(বৈরুত: দারুল ফিকর লিত্ তাবাআ ওয়ান নাশার,১ম সংস্করণ ১৪১৮হি) খ.১, পৃ.২৮১।

পড়ার পর শিয়ার করুন

Spread the love

Leave a Comment