কুরবানীর ইতিহাস-কুরবানী কিভাবে শুরু হয়?

কুরবানীর ইতিহাস, আমাদের প্রান প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেন, কুরবানি তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর সুন্নত।

কোরবানি আগেও ছিল কিন্তু বাৎসরিক নির্দিষ্ট দিনে কুরবানি করা এমন নিয়ম আগে ছিল না, যা মূলত ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়কাল থেকে শুরু হয় । যেমন ভাবে আগেও নামাজ ছিল, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় এমন ভাবে ফরজ ছিল না । একইভাবে রোজা পূর্ববর্তী উম্মতের উপরেও ফরজ ছিল কিন্তু নির্দিষ্ট রমজান মাসে এমন ভাবে ফরজ ছিল না ।

কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম (আ.) এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে।

আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেন,

“আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, ‘আল্লাহ তো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবূল করে থাকেন।(সূরা মায়িদা ২৭)।

মূল ঘটনা হলো: যখন আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের থেকে বংশ বিস্তার আরম্ভ হয় । হাওয়া (আ.) এর গর্ভ থেকে জোড়া জোড়া (জময) সন্তান জন্ম লাভ করে । অর্থাৎ একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা। কেবল শীস (আ.) তিনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, এবং তার সঙ্গে জান্নাতের হূরের বিবাহ হয়েছিল এমন তথ্য উঠে আসে।

তখন আদম (আ.) এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম।

তাই একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবীলের সাথে যে জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম ছিল আকলিমা। আর হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে তুলনামূলক কম সুন্দরী ছিল । তার নাম ছিল লিওযা।

বিবাহের সময় ‘নিয়মানুযায়ী হাবীলের সঙ্গে জন্মগ্রহণকারী কন্যা কাবীলের ভাগে পড়ল আর হাবিলের সঙ্গে জন্মগ্রহণকারী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। কাবিল তা মেনে নিতে চাইল না,

তার সঙ্গে জন্মগ্রহণকারী কন্যার সঙ্গে সে বিয়ে করতে চাইলো । ফলে আদম (আ.) তৎকালীন শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না।

অবশেষে আদম (আ.) তার এ দু‘সস্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর, যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’

সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে ভষ্মীভূত করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবূল হতো না তারটা পড়ে থকত।

তাদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- কাবীল ছিল চাষী। তাই সে গমের শীষ এর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করল।

আর হাবীল ছিল পশুপালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সেরা একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবীলের কুরবানীটি ভষ্মীভুত করে দিল।

ফতহুল ক্বাদীরের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হাবীলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে। অবশেষে ইসমাঈল যাবিহুল্লাহ (আ.) এর পরিবর্তে ঐ দুম্বাটি পাঠিয়ে তাকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়।

পক্ষান্তরে কাবীলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।

হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করলেন, তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায়?

তবুও এক পর্যায়ে যখন হাবিল কৃষি কাজে মগ্ন ছিলেন কাবিল পাথরের আঘাত করেছিল । এক পাথরের আঘাতে হাবিল মৃত্যুবরণ করেন । অবশেষে এইভাবে কাবীল হাবীল কে হত্যা করে ফেলল। কেতাবের মধ্যে পাওয়া যায়, কাবিলের থেকে হাবিল অনেক শক্তিশালী ছিল এবং অনেক বিনয়ী ছিল। সে চাইলে কাবিলের সঙ্গে লড়াই করে জীবন বাঁচাতে পারতো, কিন্তু লড়াই করাটা সে পছন্দ করেনি ।

(তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)

হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কুরবানী হিসেবে পেশ করেন।

ফলে তার কুরবানী কবূল হয়। পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন।” [সূরা হাজ্জ ৩৪]।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩)।

আদম (আ.) এর যুগে তারই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কোরবানির ইতিহাস,

সূরা আস- সাফফাত:১০০ নং আয়াতে উল্লেখ আছে । হযরত ইব্রাহিম দোয়া করলেন, “হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান কর।(আল্লাহ বলেন) অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।

অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহীম বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি, এখন বল, তোমার অভিমত কী?

সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।

দু‘জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিলেন আর ইবরাহীম তাকে কাত ক‘রে শুইয়ে দিলেন। (আল্লাহ বলেন) তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, ‘হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে।

এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবাণীর বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম।

আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার মু‘মিন বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আস- সাফফাত:১০০-১১১]।

ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন । ইসমাইলকে কোরবানি করছিলেন কিন্তু তার পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয় । আল্লাহ তাআলা এতটাই খুশি হয়ে যান যে এই কুরবানীকে পরবর্তী মুসলিম উম্মাহ এর জন্য নির্ধারণ করে দেন । তাই বলা হয় এই কোরবানি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সুন্নত । প্রত্যেক ধনী মানুষের জন্য এই কুরবানী করা ওয়াজিব ।

আঠালো পানি বের হলে গোসল ছাড়া নামাজ পড়া যাবে কি?

Spread the love

Leave a Comment