খিযির ও মূসা (আঃ) এর ঘটনা

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

খিযির ও মূসা (আঃ) এর ঘটনা

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:) হতে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) একদা বানী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমিই সর্বাধিক জ্ঞানী।

জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ না করার কারণে আল্লাহ্‌ তাকে বললেন, (হে কালিম) বরং দু’সাগরের মিলনস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। (হজরত খিজির আঃ)

হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক ! তার নিকট পৌছাতে আমাকে সাহায্য্ কর- কখনো সুফইয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, আমি কিভাবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি? তখন বলা হল, তুমি একটি থলিতে করে একটি মাছ নাও। যেখানে তুমি মাছটি হারাবে, সেখানেই আমার সে বান্দাকে পাবে।

অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) একটি মাছ ধরলেন এবং থলিতে যত্ন করে রাখলেন। অতঃপর মাছ নিয়ে তাঁর সঙ্গী ইউশা বিন নূনকে সাথে নিয়ে চললেন।শেষ পর্যন্ত তারা একটি পাথরের কাছে পৌছলেন এবং তার উপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিলেন।

মূসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলি থেকে বের হয়ে এক লাফ দিয়ে সমুদ্রে চলে গেল। অতঃপর সে সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ করে নিল। আর আল্লাহ্‌ মাছটির চলার পথে পানির প্রবাহ থামিয়ে দিলেন। ফলে তার গমনপথটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। অতঃপর তারা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন ।

তার পর পরদিন সকালে হযরত মূসা (আঃ) তার সাথীকে বললেন, আমরা তো সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাদের খাবার নিয়ে এস। হযরত মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ্‌ যে স্থানে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোনরূপ ক্লান্তিবোধ করেননি।

সাথী ইউশা বিন নুন তখন বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, যে পাথরটির নিকট আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখানেই মাছটি অদ্ভুতভাবে সমুদ্রের মধ্যে চলে গেছে । কিন্তু আমি মাছটির কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

মূলত: শয়তানই আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে (তাই মনে ছিলনা)। বর্ণনাকারী বলেন, পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত আর তাঁদের জন্য ছিল আশ্চর্যজনক ব্যাপার ।

হযরত  মূসা (আঃ) বললেন, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছি। অতঃপর তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন এবং ঐ পাথরের নিকটে পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছেন।

মূসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিযির জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হ’তে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন।

খিযির (আঃ) বললেন, হে মূসা! (আঃ) আমার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না। আর আপনিও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হ’তে পারি? খিযির বললেন, ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না।

যে বিষয় আপনার জ্ঞানের আওতাধীন নয় (আমাকে বলুন) সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কি করে?’ মূসা (আঃ) বললেন, ‘আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন ‘ইনশা আল্লাহ্‌ এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না’ (কাহফ ৬৭-৬৯)

তারপর দু’জনে সাগরের কিনারা ধরে হেঁটে চললেন। তখন একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদেরকে নৌকায় তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তারা খিযির-কে চিনতে পেরে বিনা ভাড়ায় তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো।

যখন তাঁরা দু’জনে নৌকায় চড়লেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির কিনারায় বসল এবং সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা বা দুই ফোঁটা পানি পান করল। তখন খিযির (আঃ) বললেন, ‘হে মুসা (আঃ) আমার ও আপনার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্‌ জ্ঞান হতে ততটুকুও কমেনি যত টুকু এ পাখিটি তাঁর ঠোটের দ্বারা সাগরের পানি কম করেছে’।

কিনারায় পৌঁছানোর পর,খিযির (আঃ) একটি কুড়াল নিয়ে নৌকাটির একটা তক্তা খুলে ফেললেন। মূসা (আঃ) দেখতে পেলেন যে, তিনি কুড়াল দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেছেন। তখন তিনি তাঁকে বললেন, আপনি একি করলেন? এ লোকেরা বিনা ভাড়ায় আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিলো, আর আপনি তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকা ছিদ্র করে দিলেন? আপনি তো একটি গুরুতর কাজ করলেন। (কেন এমন করলেন?)

খিযির (আঃ) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না? মূসা (আঃ) বললেন, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার এ ব্যবহারে আমার প্রতি কঠোর হবেন না। মূসা (আঃ)-এর পক্ষ থেকে প্রথম এ কথাটি ছিল ভুলক্রমে।

তাঁরা যখন উভয়ে সমুদ্র পার হলেন, তখন তারা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করছিল ।

খিযির (আঃ) বালকটির মাথা দেহ হতে ছিন্ন (হত্যা) করে ফেললেন। হযরত মুসা  (আঃ) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? আপনি কি এটা ঠিক করলেন?। খিযির (আঃ) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। জরত মূসা (আঃ) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না।

অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে তাঁরা একটি জনপদের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে তাদের নিকট কিছু খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের দু’জনের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। কোন খাবার তারা দিল না । এর পর সেখানে তারা (মূসা ও খিজির (আঃ) একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন, যা ভেঙ্গে পড়ার কাছা কাছি হয়েছিল।

হযরত খিযির (আঃ) প্রাচীরটি মেরামত করে সুদৃঢ় করে দিলেন। হযরত মুসা (আঃ) চুপ থাকতে না পেরে বললেন, এই বসতির লোকদের নিকট এসে আমরা খাবার চাইলাম। তারা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। অথচ আপনি এদের দেয়াল সোজা করে দিলেন কারণ কি ? আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন।

হযরত খিযির বললেন, এবার আমার এবং আপনার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল।এক্ষণে যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, আমি এর তাৎপর্য বলে দিচ্ছি ।

নৌকাটির ব্যাপার ছিল এই যে, সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিয়েছিলাম। কারণ, তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে ভাল নৌকা পেলেই জোরপূর্বক কেড়ে নিত।এর পর যখন এটাকে দখল করতে লোক আসল, তখন ছিদ্র দেখে নিলো না। পরে নৌকাওয়ালারা একটা কাঠ দ্বারা নৌকাটি মেরামত করে নিলো ।

আর বালকটি ছিল কাফের। আর সে ছিল তার ঈমানদার বাবা- মার বড়ই আদরের সন্তান । আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্যতা  ও কুফরি দ্বারা তাদেরকে কষ্ট দিবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম  যে, পালনকর্তা  তাদেরকে  তার  চেয়ে পবিত্রতায়  ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি নেক সন্তান  দান করবেন।

আর  প্রাচীরের  ব্যাপার  এই  যে,  সেটি  ছিল  নগরের  দু’জন  ইয়াতীম বালকের। এর নীচে ছিল তাদের গুপ্তধন। তাদের পিতা ছিলেন সৎকর্ম পরায়ণ। পালনকর্তা এটাই চান যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করে নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ ইচ্ছায় এসব করিনি। আপনি যে বিষয়গুলোতে ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, এই হ’ল  তার ব্যাখ্যা । (বুখারী হা/৩৪০১ ‘নবীদের কাহিনী’অধ্যায়)

খিযির ও মূসা (আঃ) এর ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ-

  • জ্ঞানের বড়াই বা অহংকার করতে নেই । আল্লাহ তা পছন্দ করেন না ।
  • আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন গায়েবের জ্ঞান দান করেন ।
  • সকল  জ্ঞানের আধার আল্লাহ্‌  রাববুল আলামীন। তিনি যাকে যতটকু  ইচ্ছা প্রদান করেন।
  • জ্ঞান অর্জনের জন্য সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • জ্ঞান অর্জনের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করা জরুরী।
  • বড়দের বাহ্যিক কিছু কর্ম দেখে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করা উচিত নয় । একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখা উচিৎ ।
  • ধৈর্যধারণ করতে হবে । ধৈর্যধারণের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে । হজরত মূসা (আঃ) অনেক জালালী নবী ছিলেন তাই তিনি বাহ্যিক সেই কর্মগুলো দেখে ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি । যদি তিনি ধৈর্যধারণ করতে পারতেন তাহলে হইতো আরো অনেক কিছু দেখতে পেতেন । আল্লাহ যেটা চেয়েছেন সেটাই হয়েছে ।
Spread the love

Leave a Comment