জামাতে ইমামের পিছনে কেরাত পড়তে হবে কি?

ইমামের পিছনে কেরাত

ইমাম যখন নামাযে কুরআন পাঠ করবে তখন মুক্তাদিদের চুপ থাকতে হবে নাকি ইমামের সাথে সূরা ফাতিহা বা কুরআনের অন্য কোন সূরা তিলাওয়াত করতে হবে?। বিবাদমান দুটি বিষয়ের মধ্যে হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কিরাম ইমামের কুরআন পাঠের সময়,মুক্তাদিদের জন্য নীরব থাকার মত গ্রহণ করেছেন। উক্ত মতের কএকটি দলিল তুলে ধরা হলো,,

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তা মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। তাহলে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে। (সূরা আ’রাফ: ২০৪)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবু হুরাইরা ও আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল রা. বলেন: এ আয়াত নামায ও খুতবা সম্পর্কে অবতীর্র্ণ হয়েছে। (ইবনে কাসীর: ২/২৮১)

খুতবা চলাকালীন ও নামাযে তিলাওয়াত চলাকালীন চুপ থাকতে হবে এবং শুনতে হবে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহ. বলেন:

أجمع الناس على ان هذه الآية فى الصلواة

“উম্মাত একমত যে, এ আয়াতটি নামাযের ব্যাপারে অবতীর্র্ণ হয়েছে”। (আলমুগনী: ১/৪৯০)

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. তাঁর তাফসীরে তাবারীতে ৩৮টি সনদে সেসব সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন যাঁরা বলেন যে, এ আয়াতে ইমামের কুরআন পাঠের সময়ে মুক্তাদীদেরকে চুপ থাকা এবং কুরআন শোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস, আবু হুরাইরা রা., আতা বিন আবী রবাহ, মুজাহিদ, যাহহাক, ইবরাহীম নাখঈ, কতাদা, যুহরী, আমের, শা’বী, হাসান বসরী, সাঈদ বিন যুবাইর ও সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ. উল্লেখযোগ্য। অবশেষে ইবনে জারীর তাবারী রহ. এ ব্যাপারে নিজে এ মন্তব্য করেন:

قَالَ أَبُو جَعْفَرٍ: وَأَوْلَى الْأَقْوَالِ فِي ذَلِكَ بِالصَّوَابِ قَوْلُ مَنْ قَالَ: أُمِرُوا بِاسْتِمَاعِ الْقُرْآنِ فِي الصَّلَاةِ إِذَا قَرَأَ الْإِمَامُ وَكَانَ مَنْ خَلْفَهُ مِمَّنْ يَأْتَمُّ بِهِ يَسْمَعُهُ، وَفِي الْخُطْبَةِ. وَإِنَّمَا قُلْنَا ذَلِكَ أَوْلَى بِالصَّوَابِ، لِصِحَّةِ الْخَبَرِ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ: «إِذَا قَرَأَ الْإِمَامُ فَأَنْصِتُوا» وَإِجْمَاعُ الْجَمِيعِ عَلَى أَنَّ مَنْ سَمِعَ خُطْبَةَ الْإِمَامِ مِمَّنْ عَلَيْهِ الْجُمُعَةُ، الِاسْتِمَاعَ وَالْإِنْصَاتَ لَهَا

“এ ব্যাপারে সর্বাধিক সঠিক কথা তাঁদেরটি যাঁরা বলেন যে, ইমাম যখন নামাযে কুরআন পাঠ করবেন তখন তাদেরকে (মুক্তাদী) মনোযোগ দিয়ে শোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ইমামের পেছনে যারা ইক্তিদা করেছে তারা ইমামের কুরআন পাঠ শুনবে। এ আয়াতটি খুতবার ব্যাপারেও অবতীর্ণ হয়েছে। এ মতটিকে আমি এ কারণে সর্বাধিক সঠিক বলেছি যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত রয়েছে: (اذا قرأ الإمام فانصتوا) “ইমাম যখন কুরআন পাঠ করেন তখন তোমরা চুপ থাক”। আর সবার ঐকমত্য বিদ্যমান রয়েছে যে, যাদের ওপর জুমআর নামায জরুরী তাদের মধ্যে যারা খুতবার সময় উপস্থিত থাকবে তাদের দায়িত্ব নীরব থাকা এবং মনোযোগের সাথে শোনা। (তাফসীরে তাবারী: সূরা আ’রাফ, ২০৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর)

এ আয়াতে নামাযের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে দু’টি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে: এক. মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা, দুই. চুপ থাকা। যে সব নামাযে ইমাম উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করেন এবং ইমামের তিলাওয়াতের শব্দ মুক্তাদীগণের কান পর্যন্ত পৌঁছে সেখানে উক্ত আয়াতের দু’টি নির্দেশই পালন করা সম্ভব। আর যে সব নামাযে ইমাম নীরবে তিলাওয়াত করেন অথবা ইমামের তিলাওয়াতের শব্দ মুক্তাদীগণের কান পর্যন্ত না পৌঁছে সেখানেও দ্বিতীয় নির্দেশটি পালন করা অর্থাৎ, চুপ থাকা সম্ভব। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন করা সম্ভব হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তা অমান্য বা প্রত্যাখ্যান করার কোন সুযোগ শরীআতে নেই। সুতরাং ইমাম যখন নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করেন, তা সরবে হোক বা নীরবে সর্বাবস্থায় মুক্তাদীগণের দায়িত্ব হলো নীরব থাকা। সূরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা তিলাওয়াত না করা।

কুরআনের উক্ত স্পষ্ট আয়াতের ওপর আমল করতে যদিও কোন ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না, তবুও উক্ত আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশ সমর্থন করে রসূলুল্লাহ (সাঃ) যে হুকুম জারী করেছেন, তা থেকেও কিঞ্চিত আপনাদের খেদমতে তুলে ধরা হচ্ছে।

ইমামের পিছে কেরাত না পড়াড় হাদিস

১. হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ইমাম বানানো হয়েছে তাকে অনুসরণ করার জন্য। যখন তিনি তাকবীর দেন তোমরাও তাকবীর দিবে। যখন তিনি কুরআন পাঠ করেন তখন তোমরা চুপ থাকবে। (ইবনে মাজাহ: ৮৪৬, পৃষ্ঠা: ১/৬১, মুসলিম: ৭৯০, ইবনে আবী শাইবা: ৩৮২০)

হাদিসের মান সহিহ, এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী/মুসলিম এর রাবী যাদের নির্ভরযোগ্যতা সমগ্র উম্মাতের নিকটে স্বীকৃত।

ইমাম মুসলিম (রহ)-এর নিকটে তাঁর ছাত্র আবু বকর (রহ) জিজ্ঞেস করেন যে,

فَحَدِيثُ أَبِى هُرَيْرَةَ فَقَالَ هُوَ صَحِيحٌ يَعْنِى وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا

“ইমাম যখন কুরআন পাঠ করে তখন তোমরা চুপ থাক। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি কেমন? ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন: ওটা আমার নিকটে সহীহ”। (মুসলিম: ৭৯১)

২. হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ইমাম যখন কুরআন পাঠ করে তখন তোমরা চুপ থাক। যখন বৈঠকের সময় হয় তখন তোমাদের প্রথম জিকির হবে তাশাহহুদ। (ইবনে মাজাহ: ৮৪৭)

হাদীসটির মান

এই হাদিসটি সহীহ এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী/মুসলিমের রাবী যাদের নির্ভরযোগ্যতা সমগ্র উম্মাতের নিকটে স্বীকৃত।

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশ হলো ইমামের কুরআন পাঠের সময়ে মুক্তাদীগণের চুপ থাকা।

হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. বলেন, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি এক রাকাত নামাযও পড়লো অথচ তাতে সূরা ফাতিহা পড়লো না, সে যেন নামাযই পড়লো না। তবে যদি সে ইমামের ইকতিদা করে নামায আদায় করে তাহলে ভিন্ন কথা। (ত্বহাবী: ১৩০০)

হাদিসের মান

সহীহ লিগইরিহী। বিন নাসর এবং ইয়াহইয়া ব্যতীত এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী-মুসলিমের রাবী।

হযরত জাবির বিন আব্দুল্লা থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: যার ইমাম আছে তার জন্য ইমামের কিরাতই যথেষ্ট। (ইবনে আবী শাইবা: ৩৮২৩, ইবনে মাজাহ: ৮৫০)

হাদিসের মান

সহীহ লিগইরিহী। এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী/মুসলিমের ثقةٌ “নির্ভরযোগ্য” রাবী। হাসান বিন সালেহ-এর ব্যাপারে কোন কোন মুহাদ্দিস এ আপত্তি করে থাকেন যে, তিনি আবুয যুবাইর থেকে শোনেননি। কিন্তু এ অভিযোগ যথার্থ নয়। কারণ, হাসান বিন সালেহ ثقةٌ “নির্ভরযোগ্য” রাবী এবং তাঁর বিরুদ্ধে তাদলীসের কোন অভিযোগ নেই।

হযরত ইবনে আদী রহ. বলেন: (ولم أجد له حديثا منكرا مجاوز المقدار، وَهو عندي من أهل الصدق) “বড় ধরণের কোন মুনকার হাদীস আমি তাঁর থেকে পাইনি। তিনি আমার দৃষ্টিতে সত্যবাদী”। (আলকামিল: ৪৪৮)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ রা. বলেন, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: যার ইমাম আছে তার জন্য ইমামের কিরাতই যথেষ্ট। (ইবনে আবী শাইবা: ৩৮০০)

হাদিসের মান

হাদীসটির স্তর : সহীহ। এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী-মুসলিমের প্রসিদ্ধ রাবী। আর হযরত আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ রা. সাহাবা। তাঁর বিষয়ে ইবনে হাজার রহ. বলেন, له رؤية “তিনি রসূলুল্লাহ স.কে দেখেছেন”। (আল ইসাবা: হযরত শাদ্দাদ ইবনুল হাদ-এর জীবনী আলোচনায়)

হাদীস নম্বর-১৪২ : হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: আমরা সিজদারত অবস্থায় যদি তোমরা নামাযে উপস্থিত হও তাহলে সিজদা করবে; তবে তা (রাকাত হিসেবে) গণনা করবে না। যে রুকু পেলো সে নামায পেলো। (আবু দাউদ: ৮৮৯)

হাদীসটির স্তর : হাসান।

সংক্ষিপ্ত আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল যে জামাতে নামাজ আদায় করলে মুকতাদিগণ কেরাত (সুরা) পড়বে না ।

এবার পড়ুন

Spread the love

Leave a Comment